ইনসানে কামেল

পঞ্চম অধ্যায়

ঈমান নষ্টকারী কার্য সমূহের বিবরণ

মুসলমানের মূলধন ঈমান। আর মূল মন্ত্র হলো কলেমাতুত তাকওয়া- “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)।” কোন কারণে যদি এই ঈমান নষ্ট হয়ে যায়, তবে দ্বীন ও দুনিয়াতে আর কিছুই থাকল না। তাই অত্যন্ত হুশিয়ারীর সাথে ঈমান নষ্টকারী বিষয়গুলো ভালভাবে জেনে, বুঝে, চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে, তা থেকে দূরে থাকার পন্থা নির্ধারণ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজ এবং এবাদতের প্রতিটি শাখার প্রতিও নজর রাখতে হবে যেন ঈমান রূপ রাস্তা থেকে নিজের অলক্ষ্যে দূরে সরে না পরে।
অনেক সময় দেখা যায়, জ্ঞানের অভাবে সে বে’দাত কাজকে ঈমানের অংশ মনে করে সারা জীবন ছওয়াবের আশায় উৎসাহ ভরে করে যাচেছ। ভুল আমলের জন্য আল্লাহর বান্দা ও রাসুলের উম্মত হতে নাম খারিজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ভাবে নামাজ পড়ছে, রোজা রাখছে, কোরআন তেলোয়াত করছে, জিকির আজকার করছে, হজ্জ করছে, যাকাত ও দান খয়রাত করছে। অথচ এসব এবাদতের একটিও আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। অর্থাৎ তার সারা জীবন ভুলের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো। হায়, কি দুর্ভাগ্যের কথা!
“বেগায়ের মুসলমানছে কুই এবাদত কবুল নেহি হুতী।”
আল্লাহ পাকের দরবারে বান্দার এবাদত কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহ পাক যে সকল শর্ত আরোপ করেছেন, শেরেক বা কুফরী করার পর তার কোন এবাদত আল্লাহর দরবারে এবাদত বলে গণ্য হবে না। তাই কেউ যদি ভুল বশতঃ শেরেক করেই ফেলে তবে তাকে নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর আযাবের ভয়ে চোখের পানিতে বক্ষ পাব্লিত করে দয়াময় আল্লাহর শাহী দরবারে আজিজি এনকেছারির সাথে লজ্জিত মনে দু’হাত তুলে ক্ষমা চাইতে হবে। খালেছ অন্তরে তওবা করতে হবে, ফরিয়াদ করতে হবে।
আয় মাবুদ! আমি বুঝতে না পেরে, শয়তানের ধোঁকায় পরে ভুল করেছি, নাফরমানি করেছি। তা থেকে মুক্তির জন্য তোমার দরবারে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছি- নিশ্চয় তুমি অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল, ক্ষমাকেই তুমি পছন্দ কর। আমি এরূপ কাজ আর কখনও করবো না। আমার প্রতি রহম কর! আমি তোমারই হাবীবের উম্মত- তাঁর উছিলায় আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে তোমার হাবীবের দ্বীনের উপর কবুল কর।
কলেমায়ে তৌহিদ- “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।”
কলেমায়ে শাহাদাত-
“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শারিকালাহু অ-আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।”
ইয়া আল্লাহ! ইয়া রাহমানুর রাহিম! আমাকে আমার প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদার উপর প্রতিষ্ঠিত কর এবং কায়েম রাখ। আল্লাহর হাবীব বলেছেন-
“গায়রুল্লাহর নামে কেউ শপথ করলে কাফের বা মুরশীক হয়ে যাবে।” (তিরমিজি শরীফ)
মুসলমান ব্যক্তি যদি কোন প্রকার কুফরী বা শেরেকী না করে তবে সে যত গুনাহের বোঝা নিয়েই মৃত্যু মুখে পতিত হোক না কনে, সে একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত দোজখে শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর মেহেরবাণীতে নবী (সাঃ)- এর শাফায়াত লাভ করে বেহেশতে যাবে। কিন্তু কাফের এবং মোশরীকগণ অনন্তকাল দোজখের কঠিন আযাবে জ্বলতে থাকবে। কোনদিন মুক্তি পাবে না।
তাই কিসে শেরেকী হয়, কিসে কুফরী হয় এ বিষয়গুলি ভালভাবে জানা থাকা দরকার। নচেৎ ঈমান নিয়ে দুনিয়া হতে বিধায় নেয়া খুব কষ্টদায়ক হয়ে যাবে। যার ঈমান ও অকিদায় বিন্দু মাত্র শেরেকী ও কুফরী থাকবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে, চির জাহান্নামী হবে।

শিরক কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কি কি?

শিরক অর্থ অংশীবাদ। অর্থাৎ একাধিক স্রষ্টা, একাধিক উপাস্যে বিশ্বাস করা। মহান আল্লাহ পাকের জাত বা সিফাতের যে কোন একটির সাথে অপর কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে শরিক করা বা কাউকে তার সমগুণ স¤পন্ন মনে করাকে শিরক বলে। যে ব্যক্তি শিরক করে তাকে মুশরিক বলে। আল্লাহর ইবাদতে অন্য কোন শক্তি বা পদার্থকে শামিল করাও শিরক। শিরক জঘন্য অপরাধ। এ স¤পর্কে আল্লাহ পাক বলেন-
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার গুনাহ ক্ষমা করেন না, তা ছাড়া অন্য যে কোন গুনাহ যাকে ইচছা ক্ষমা করেন। ”(সুরা আন-নিসা-১১৬)

তিনি আরো বলেন-
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করেছেন এবং তার স্থান দোজখে।” (সুরা মায়েদা)

শিরক করলে শুধু অমার্জনীয় অপরাধই করা হয় না বরং এর মাধ্যমে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানুষকেও অমর্যাদা করা হয়। কেননা, আল্লাহ পাক মানুষকে এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর অন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারের জন্য। মানুষের মধ্যে এমন সব গুণ দেয়া হয়েছে যার মাধ্যমে মানুষ অন্য সব সৃষ্টিকে বশে এনে নিজের কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম। কিন্তু মোশরীকরা ঐসব সৃষ্টির কাছেই মাথা নত করে প্রকারান্তরে সে নিজকেই ছোট করছে। আর শিরকের জন্যই মানব সমাজে বিবাদ ও বিভেদ সৃষ্টি হচেছ।
শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আন্তরিকতার সাথে তওবা করে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং নতুন ভাবে ঈমান আনলে আল্লাহ পাক হয়ত দয়া করে এ অপরপাধ ক্ষমা করে দিতেও পারেন।
নিঃসন্দেহে শিরক হচেছ এক গুরুতর অপরাধ। এটাকে সাধারণতঃ তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা:-
১। শিরক ফিয্যাত ২। শিরক ফিররাবুবিয়াত ৩। শিরক ফিস সিফাত
এর মাঝে আরো ৫টি বিষয় আছে। সেগুলো হলো-
১) শিরক ফিল ইলম ২) শিরক ফিল তাসরুফ ৩) শিরক ফিল ইবাদত ৪) শিরক ফিল আদত ৫) শিরকে আজগর (রিয়া)।
শিরক একটি মারাত্বক অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও প্রাত্যহিক জীবনে আমরা অজ্ঞতা ও অসতর্কতা বশতঃ যে সব শিরক করে থাকি তার কয়েকটি নমুনা নিুে দেয়া হলো-
১) কোন বুজর্গ বা পীর সম্বন্ধে এ রকম আকীদা বা ধারণা পোষণ করা (রাখা) যে তিনি সব সময় আমাদের সকল অবস্থাই জানেন, দেখছেন।
২) জ্যেতির্বিদ বা গণকের নিকট অদৃষ্টের কথা জিজ্ঞাসা করা।
৩) কোন পীর বুজুর্গকে দূর দেশ হতে ডাকা এবং মনে মনে এই ধারণা পোষণ করা যে তিনি আমার কথা শুনছেন।
৪) কোন পীর বুজুর্গ, দৈত্য, পরী বা ভূত ও ব্রাহ্মণকে লাভ-লোকসানের মালিক মনে করা।
৫) কোন পীর বুজুর্গের কবরের নিকট আওলাদ (সন্তান) বা অন্য কোন কিছু চাওয়া।
৬)পীর বা কবরকে সেজদা করা।
৭) কোন পীর বুজর্গের নামে শিরনী, ছদকা বা মান্নত মান্য করা।
৮) কোন পীর বুজুর্গের দরগাহ বা কবরের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে তওয়াফ করা।
৯) আল্লাহর হুকুম ছাড়া অন্য কারও আদেশ বা সামাজিক প্রথা পালন করা।
১০) কারও সামনে মাথা নত করে সালাম করা বা হাত বেঁধে নিস্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
১১) মহররমের সময় তাজিয়া বানানো।
১২) কোন পীর বুজর্গের নামে পশু জবাই করা, বা কারও দোহাই দেয়া।
১৩) কোন পীরের বাড়ী বা কোন পীরের দরগাহ বা তীর্থ স্থানকে কা’বা শরীফের মত আদব অথবা তাজিম করা।
১৪) কোন পীর বা বুজুর্গের নামে ছেলে মেয়ের কান ফুটানো, আংটি পরানো, চুল রাখা বা টিকি রাখা ইত্যাদি।
১৫) আলী বক্স, হোসেন বক্স, খোদা বক্স ইত্যাদি নাম রাখা।
১৬) কোন জিনিসের বা ব্যরামের ছুত লাগে বলে মনে করা।
১৭) সওয়াব মনে করে মহররম মাসে পান না খাওয়া, নিরামিষ খাওয়া, খিচুরী খাওয়া।
১৮) নক্ষত্রের তাছির মানা বা তিথি পালন করা।
১৯) বার বা তারিখের ভাল মন্দ জিজ্ঞাসা করা। যেমন- এই চাঁদে বিবাহ আছে কিনা, কোন দিন নতুন ঘরে যাওয়া যাবে, কোন দিন ঘর উঠনো যাবে আর কোন দিন উঠনো যাবে না, রোববার, বৃহ¯পতিবার ঝাড় থেকে বাঁশ কাটা যাবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বাস করা।
২০) গণকের উপর অথবা যার উপর জ্বীন আছর হয়েছে বলে ধারণা করে তাকে হাত দেখিয়ে ভবিষ্যতের সুখ দুঃখ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা। এক কথায় অদৃষ্টের কথা জিজ্ঞাসা করা।
২১) কোন জিনিস হতে কু-লক্ষণ ধরা, কু-যাত্রা মনে করা। যেমন- অনেকেই যাত্রা মুখে খালি কলস দেখলে, তেলি দেখলে, কেউ হাঁচি দিলে, কোন কিছুতে ধাক্কা বা ঠোকর খেলে, বাম দিক হতে অন্য কোন দিকে শৃগাল গেলে কু-লক্ষণ হিসাবে মনে করা।
২২) কোথাও রওনা হয়ে যাওয়ার কালে, ভোর বেলা দোকানের দরজা খুলে প্রথমেই দরজায় পানি ছিটানো বা লেপে দেয়া। ব্যবসা বেশী হবার আশায় ঘরের দরজায় বা চৌকাঠে সালাম করা অথবা দরজার মাটিকে সালাম করা।
২৩) কোন দিন বা মাসকে অশুভ মনে করা।
২৪) কোন বুজুর্গের নামে অজিফা পড়া।
২৫) এইরূপ বলা যে উপরে আল্লাহ আর নীচে আপনি। যেমন- নব বধুকে স্বামীর হাতে তুলে দেয়ার সময় অনেক মূর্খ সমাজে এই প্রথার প্রচলন আছে।
২৬) কাউকে পরম পূজনীয় বলা বা লিখা (আল্লাহ ব্যতিত)।
২৭) কারো নামে কসম খাওয়া বা কিরা কাটা।
২৮) এরূপ বলা যে কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলে না, জয় কালি নেগাবান।
২৯) পথের তে-মাথায় ভেট দেয়া, পূজা উপলক্ষ্যে কাজ বন্ধ রাখা, মনসা পূজা, জন্মাষ্টমি বা দশরা উপলক্ষ্যে নৌকা বাইশ, আরঙ্গ, মেলা, মিছিল, উৎসব বা কোন পরবে যাওয়া। পৌষ সংক্রান্তিতে গরু দৌড়, ঘোড়া দৌড়, পূজা উৎসবে পূজা বা মূর্তি দেখতে যাওয়া এবং এ সব উপলক্ষ্যে নতুন কাপড় কেনা বা পড়া, আনন্দ উপভোগ করা, ফুর্তি করা, বা পার্বনী দেয়া ।
৩০) নিজের বা পিতা-মাতার, পীর-বুজুর্গের, দাদা-দাদীর, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, নেতা, প্রেসিডেন্ট বা কারো ফটো তুলে স্মৃতিস্বরূপ ঘরে রাখা। এ ছাড়া জানদার জীব-জানোয়ারের ছবি বা মূর্তি, খেলনা বা পুতুল, ছেলে বা মেয়েদের খেলার সামগ্রী হিসাবে কিনা অথবা তৈরী করে দেয়াও অন্যায়। এ সব ছবি বা মূর্তিকে ঘরে রেখে যতœ করে তাজিম করা বা মালা দেয়া সম্পূর্ণ কবীরা গুনাহ।
প্রথম ৩ প্রকার কবীরা গুনাহ ও তার পরিচয়
শিরক ফিযযাত: –
আল্লাহ তায়ালার একাদিক সত্তা আছে বলে মনে করা। যেমন- কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেক কাজের জন্য একজন ইলাহ আছে। হযরত মুসা (আঃ)-কে তখনকার লোকেরা বলেছিলো- “ওগো মুসা! আমাদের জন্য একটা উপাস্য (আমরা যার এবাদত করতে পারি এমন) বা একটি মূর্তি স্থাপন করে দাও। তখন হযরত মুসা (আঃ) বলেছিলেন- ‘তোমরা তো মূর্খ জাতি। এই দুনিয়া বা আকাশ মন্ডলে যদি এক আল্লাহ ছাড়া বহু ইলাহ্ বা আল্লাহ থাকতো তবে তাদের মধ্যে মতানৈক্য হয়ে এবং সময়ের হের ফেরে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতো। আল্লাহ মহান, তিনি একাই সবকিছু করেছেন, করছেন এবং করবেন। তাঁর কোন শরীক নাই। তিনি অমর । সর্বক্ষণ সব স্থানে তিনি বিদ্যমান । তাঁর কোন আকার নেই, তিনি নিরাকার। তাঁর কোন মূর্তিও হবে না। তিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বিধানদাতা। অদৃশ্য জ্ঞান চক্ষুতে তিনিকে এবং তিনির সৃষ্ট বস্তুকে দর্শন করে তাঁর মাঝে মালিকুল মূলক আল্লাহ পাকের উপস্থিতির অস্তিত্ব বুঝে বিশ্বাস করতে হবে, মানতে হবে, হুকুম পালন করতে হবে।”
তাই, সকল মানুষকে সর্বক্ষণ একমাত্র এই আল্লাহর এবাদত করতে হবে। অন্য কারো নয়। তার জাত সম্বন্ধে আর কিছু ভাবা যাবে না। ভাবার দরকারও নেই।
শিরক ফির রাবুবিয়াত: –
যে সমস্ত কাজ সম্পাদনের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর আছে, সে সকল কাজ করার ক্ষমতা অপর কারোর মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা। যেমন- সন্তান দান করা, ধনস¤পদ দান করা, নতুন কিছু সৃষ্টি করা, জীবন দান করা, মৃত্যু ঘটানো প্রভৃতি কাজগুলি শুধু আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ ছাড়া এ কাজগুলো অন্য কেউ করতে পারবে বলে ধারণা এবং বিশ্বাস করার নামই হলো শিরক ফির রাবুবিয়াত।
ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া অন্য কারও নিকট সাহায্য কামনা করা যাবে না। করলে সে অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হবে। আল্লাহ যার মঙ্গল করেন, তার অমঙ্গল করার ক্ষমতা কারোর নেই। আর যাকে বিপদে ফেলেন তাকে উদ্ধার করার ক্ষমতাও কেউ রাখে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মঙ্গলময়। তিনি যাকে ইচছা মঙ্গল দানে সৌভাগ্যশালী করে থাকেন।
শিরক ফিস সিফাত: –
আল্লাহ পাকের জ্ঞান ও গুণাবলীর অনুরূপ জ্ঞান ও গুণাবলীর অপর কোন সত্ত্বা আছে বলে বিশ্বাস করাকেই শিরক ফিস সিফাত বলে। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। তিনি সর্ব শক্তিমান। তিনি সর্বজ্ঞ ও গায়েব সম্বন্ধে অবহিত। এ সব গুণ অন্য কারো মধ্যে আছে এবং তিনি গায়েব সম্বন্ধে জানেন বলে বিশ্বাস করাকেই শিরক ফিস সিফাত বলে।
নবী, পীর, আউলিয়া, গাউস কুতুব, জ্বীন পরী, এরা কেউ গায়েব সম্বন্ধে কিছুই জানে না এবং ঐ সব গুনাবলীর একটির অধিকারী তারা নয়। কাউকে এসব গুণের অধিকারী বলে বিশ্বাস করাও শিরক।
আল্লাহর রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- এর জীবনে বহুবার বিভিন্ন ধরণের বিপদ আপদ এসেছে। তিনি নিজে নবী হয়েও এগুলো থেকে নিজকে রক্ষা করতে পারেননি। এমনকি ভবিষ্যতে কি হবে তা জানতেও তিনি পারেননি। ওহুদের যুদ্ধই তার জলন্ত প্রমাণ। বস্তুতঃ সব রকম বিপদ আপদ এবং মঙ্গলজনক কাজের ফলাফল আল্লাহ পাকের নিকট থেকেই আসে।

আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন-
“সকল প্রকার বিপদই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুমতিক্রমেই এসে থাকে।”

এতো গেলো প্রথম তিনটি শিরকের বর্ণনা। এবার অপর ৫টি শিরক সম্বন্ধে নিুে বিম্তারিত বিবরণ দেয়া গেলো-
১) শিরক ফিল ইলম:- সকল সময় সকল স্থানে উপস্থিত থাকা বা সর্বত্র বিরাজমান থাকা, সকল বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান রাখা, প্রকাশ্যে-গোপনে, দূরে-কাছে, আলোকে-অন্ধকারে, আকাশে-পাতালে সর্বত্র সকল বস্তুর উপর সমভাবে খবর রাখা একমাত্র একক প্রভু আল্লাহর অধিকার ভুক্ত। তাঁকে ছাড়া আর কারো পক্ষে এ সব গুণাবলীর অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। এসব গুনাবলীতে অন্য কাউকে শরীক করাকেই শিরক ফিল ইলম বলে। যে করবে সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই কাফের হয়ে যাবে।
২) শিরক ফিত তাসাররুফ:- সব বিষয়ে সর্বকালে পূর্ণ এখতিয়ারে ইচছা মতো হুকুমজারী, ইচছা মত জন্ম মৃত্যু দান, ইচছা মতো প্রাণী জগতের রুজী দান, রুজী বাড়ানো কমানো, ইচছা মতো রোগ শোক দান, সুস্থতা প্রদান, নানা প্রকার বালা-মুসিবত হতে রক্ষা করা, ইজ্জত দান করা, বেইজ্জতি হওয়া এর সব কিছুই আল্লাহর এক্তিয়ার ভুক্ত। এটা তারই ক্ষমতা, এটা তারই কাজ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে এ ধরণের কোন ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করাই শিরক ফিত তাসারুফ্। এরূপ আকিদা পোষণকারী নিশ্চয় মুশরিক।
৩) শিরক ফিল ইবাদাত:- শুধুমাত্র তাঁর উদ্দেশ্যে, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নামাজ কায়েম করা, রোজা রাখা, হজ্জ স¤পাদন করা, মান্নত ও নজর নিয়ায করা, সদকা, খয়রাত ও কোরবানী ইত্যাদি যা কিছু ইবাদত নামে পরিচিত সেইগুলিকে শুধু তার জন্যই সুনিদৃষ্ট রাখা হয়েছে। এতে আর কাউকে শরীক করা যাবে না। আর কারো এবাদত করা যাবে না। এমনকি কল্পনা করাও যাবে না। করলে সে মুশরিক হবে। এরই নাম শিরক ফিল ইবাদত।
৪) শিরক ফিল আদত:- বান্দা তার সমুদয় কাজে শুধু আল্লাহকেই স্মরণ করবে। তাঁর জন্যই হবে সমুদয় প্রশংসা ও উত্তম প্রশস্তি। প্রত্যেক কাজের শুরুতেই তাঁর পবিত্র নাম লওয়া, বিপদ আপদের সময় তাকেই ডাকা, সুখে দুঃখে তাকেই স্মরণ করা, কোন কাজ করার ইচছা করলে শুধু আল্লাহর ইচছার উপর নির্ভশীল হওয়া, দ্বীনদার কাজে আল্লাহর রহমত ও মদদ আসবে এরূপ ধারণা করা, চলা-ফেরা উঠা-বসা বলতে গেলে জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহকে অন্তরে স্মরণ রাখার অভ্যাস করা। সর্বক্ষণ আল্লাহ সঙ্গে আছেন বলে ধারণা করা প্রতিটি ঈমানদার লোকের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এসব ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম স্মরণ করা এবং অন্য কারোর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস প্রদর্শন করা (যেমন- তিনির দ্বারাও আমার কার্যের সাহায্য হবে এরূপ বিশ্বাস করাই) শিরক ফিল আদত। অভ্যাস মূলক অংশীদার ও শিরক। আল্লাহ পাক বলেছেন-
“বল তোমরা নিজেদের সম্বন্ধে বিবেচনা করে দেখ। তোমাদের প্রতি আল্লাহর কোন আযাব যদি আসে অথবা কিয়ামত যদি এসে পড়ে তখন আল্লাহকে ছাড়া কি তোমরা অপর কাউকে আহবান করবে? যদি তোমরা সত্যবাদী হও কখনই তা করবে না বরং তোমরা আহবান করবে তাঁকেই যে বিপদের কারণে তাঁকে আহবান করেছ, ইচছা কারলে তিনি সে আপদগুলো দূর করে দেবেন আহবানের কারণে। আর তোমরা যা কিছুকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করছ- তাদেরকে তখন তোমরা ভুলে যাবে।”
নিশ্চয় শিরক যাবতীয় নেক আমলকে বর্বাদ এবং নিষ্ফল করে দেয়। মুশরিককে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। যদি তারা মৃত্যুর আগে তওবা না করে।
৫। শিরক আজগর রিয়া:-
আল্লাহর হাবীব ফরমায়েছেন-
“আমি তোমাদের স¤পর্কে সবচেয়ে যে বিষয়ে আশংকা করি তা হচেছ শিরক আসগর (রিয়া)।”
শিরক আজগর বা রিয়া কি? জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন- তারই নাম রিয়া যা লোক দেখানো আমল। যে আমল শুধুই লোক দেখানো, আল্লাহকে খুশী করার জন্য নয়, তাই রিয়া।
এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন-
“যে সকল নামাজি অবহেলার সঙ্গে এবং লোক দেখানো নামাজ পড়ে তাদের জন্য ভীষণ আজাব।”
আল্লাহর হাবীব বলেছেন- “যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা রাখে সে শিরক করে। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর আশায় (সুনামের জন্য) দান খয়রাত করে সেও শিরক করল। আর গায়রুল্লাহর নামে কছমকারীগণও শিরককারী।”
আল্লাহর হাবীব আরো ফরমায়েছেন-
“রিয়া সামান্য হলেও তা এক প্রকার শিরক।” আল্লাহর এবাদত করার সময় মনে এমন ধারণা রাখা যে, আমার এবাদত লোকেরা দেখুক এবং লোকের নিকট আমার সম্মান হউক। লোক সমাজে প্রচার হউক যে আমি আবেদ। এ সকল এবাদতই শিরকে আসগর বা রিয়া। আল্লাহর এবাদতে সামান্যতম রিয়ার লেশ থাকলেও তা শিরক বলে গণ্য হবে। যা আমলকে বর্বাদ করে দেবে এবং সে সঙ্গে আমলকারীকে জাহান্নামের যোগ্য করে দেবে।

আল্লাহ পাক বলেছেন-
“আমি (হাশরের দিন) তাদের আমলগুলি বিচারে প্রবৃত্ত হব, (তা তন্ন তন্ন করে দেখব, পরীক্ষা করব) অতঃপর (রিয়া মিশ্রিত) আমলগুলিকে তছনছ করে বিক্ষিপ্ত বালু কণায় পরিণত করে দেব।” (সুরা ফোরকান, ১৯ পারা, আয়াত ১৩)

আল্লাহ পাক বান্দাগণকে তার ইবাদতের তরিকা বাতলে দিয়েছেন এবং নমুনাও পাঠিয়েছেন যাতে বান্দাগণ পথ ভ্রষ্ট না হয়।

আল্লাহ পাক আরো বলেছেন-
“সুতরাং তুমি আল্লার এবাদত কর তার জন্য দ্বীনকে সম্পূর্ণ ভাবে পবিত্র করে খালেছ করে (নির্ভেজাল ভাবে, বিশুদ্ধ চিত্তে)।”

নমুনা স্বরূপ আল্লাহ তাঁর হাবীবকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন এবং মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন-

“তোমরা পূর্ণভাবে তাঁকে বিশ্বাস কর। তাঁর পূর্ণ আনুগত্য, অনুসরণ ও অনুকরণ কর। তা হলেই তোমরা সঠিক ভাবে আল্লাহর এবাদত করে আল্লাহকে খুশী ও রাজি করতে সক্ষম হবে। হোব্বে জাহ (অর্থাৎ লোক সমাজে সম্মানিত ও বড় হবার আশা ) দূর হয়ে যাবে। রিয়া হতে মুক্তি লাভ করবে।
এর চিকিৎসা করতে হলে আমাদের নিচের লিখিত বিষয়গুলির প্রতি নজর দিতে হবে-
প্রথমতঃ- হোব্বে জাহ দূর করতে হবে। কেননা, হোব্বেজাহের কারণেই রিয়াকারী তৈরী হয়।
দ্বিতীয়তঃ- জামায়াতের নামাজ ছাড়া অন্যান্য এবাদত পুশিদা (গুপ্তভাবে), লোকের অগোচরে করতে হবে। এতদ্ব্যতীত যে সকল কাজ প্রকাশ্যে করার হুকুম আছে সেখানে হোব্বেজাহ দূর করে দিলেই যথেষ্ট হবে।
আমার পর দাদা পীর কুতুবুল আখতার হযরত হাজী ইমদাদুলুল্লাহ সাহেব মোহাজেরে মক্কী (রঃ) অন্য একটি চিকিৎসা বাতিয়েছেন-
যে এবাদতে রিয়া মনে আসে সে এবাদত খুব বেশী বেশী করে করতে হবে। তা হলে সে দিকে কেউ ভ্রুক্ষপ করবে না এবং কিছু দিন পরে রিয়া আদতে অর্থাৎ অভ্যাস এবাদতেও পরিণত হবে।
(চলবে———)

Related posts

Leave a Comment